শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ০৬:১৯ অপরাহ্ন

হেমিংওয়ের উপন্যাসের জগৎ…..!

হেমিংওয়ের উপন্যাসের জগৎ…..!

স্বকৃত নোমান: এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে বিশ্বসাহিত্যে প্রভাববিস্তারী ঔপন্যাসিকদের একটা তালিকা তৈরি করলে মার্কিন ঔপন্যাসিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ের নামটি শুরুর দিকে থাকবে। তার জন্মের প্রায় ১২০ বছর পরেও বিশ্বসাহিত্যে তার প্রভাব দৃশ্যমান। বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের কাছে তার গল্প-উপন্যাস বহুল পঠিত। বিশ শতকের উপন্যাসের ভাষার ওপর যে তার নির্মেদ ও নিরাবেগী ভাষার প্রভাব ছিল, তা তো জানা কথা। তার অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় ও জনপ্রিয় ইমেজও পরবর্তী প্রজন্মের ওপর ভীষণ প্রভাব ফেলেছিল। গত শতকের বিশের দশকের মাঝামাঝি থেকে পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত সময়ে হেমিংওয়ে তার অধিকাংশ সাহিত্যকর্ম রচনা করেন। সাতটি উপন্যাস, ছয়টি ছোটগল্প সংকলন আর দুটি নন-ফিকশন প্রকাশিত হয়েছিল তার জীবৎকালেই। মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয় আরো তিনটি উপন্যাস, চারটি ছোটগল্প সংকলন আর তিনটি নন-ফিকশন।
হেমিংওয়ের ‘অ্যাক্রস দ্য রিভার অ্যান্ড ইনটু দ্য ট্রিজ’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ১৯৫০ সালে চার্লস স্ক্রিবনার্স সন্স থেকে। আগের বছর উপন্যাসটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় কসমোপলিটান সাময়িকীতে। যুক্তরাষ্ট্রের গৃহযুদ্ধের কনফেডারেট জেনারেল টমাস জে (স্টোনওয়েল) জ্যাকসনের শেষ উক্তি ‘লট আস ক্রস অভার দ্য রিভার অ্যান্ড রেস্ট আন্ডার দ্য শেড অব দ্য ট্রিজ’ থেকে উপন্যাসটির শিরোনাম নিয়েছিলেন তিনি। এই উপন্যাসে ৫০ বছর বয়সী কর্নেল রিচার্ড ক্যান্টওয়েলের জীবনের পূর্বস্মৃতি ও তার প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতা বর্ণিত হয়েছে। হেমিংওয়ে ১৯৪৮ সালে এ ই হোচনারের সঙ্গে পরিচিত হন, যখন হোচনার বিমান বাহিনীর চাকরি ছেড়ে দিয়ে কসমোপলিটান সাময়িকীতে কমিশনপ্রাপ্ত এজেন্ট হিসেবে যোগ দেন। হেমিংওয়ের নামটি ছিল লেখকদের নামের তালিকায়। তাই হোচনারকে যোগাযোগ করতে হয়েছিল তার সঙ্গে। তিনি কিউবায় গিয়ে হেমিংওয়ের সঙ্গে দেখা করতে চান এবং একটি ছোট প্রবন্ধ লিখতে বলেন। হেমিংওয়ে প্রবন্ধ না লিখে ‘অ্যাক্রস দ্য রিভার অ্যান্ড ইনটু দ্য ট্রিজ’ লিখে হোচনারের কাছে জমা দেন। কসমোপলিটান বইটিকে ধারাবাহিকভাবে পাঁচ কিস্তিতে প্রকাশ করেছিল।
‘আ ফেয়ারওয়েল টু আর্মস’ হেমিংওয়ের একটি যুদ্ধবিরোধী উপন্যাস। ১৯২৯ সালে প্রকাশিত এ বইটি আসলে তার প্রায় আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস। বইটির বেশির ভাগ অংশই তিনি তার আরকানসর পিগটে শ্বশুরবাড়িতে বসে লেখেন। উপন্যাসটি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইতালীয় সেনাবাহিনীতে একজন অ্যাম্বুলেন্স চালক হিসেবে কর্মরত মার্কিন লেফটেন্যান্ট ফ্রেডেরিক হেনরি চরিত্রটির দৃষ্টিকোণ থেকে রচিত হয়েছে। এই অ্যাম্বুলেন্স চালক আসলে হেমিংওয়ে নিজেই। ১৯১৮ সালের শুরুর দিকে তার বয়স যখন উনিশ, কানসাস সিটিতে রেডক্রসের নিয়োগ কার্যক্রমে সাড়া দেন তিনি। অ্যাম্বুলেন্স চালক হিসেবে নিয়োগ পান ইতালিতে। নিউইয়র্ক সিটি ছেড়ে যান সে বছরের মে মাসে। জুনের মধ্যে পৌঁছে যান ইতালীয় রণাঙ্গনে। মিলান শহরে উপস্থিত হওয়ার প্রথম দিনই তাকে একটি যুদ্ধোপকরণ কারখানার বিস্ফোরণস্থলে পাঠানো হয়, যেখানে উদ্ধারকর্মীরা নারী শ্রমিকদের লাশের টুকরা অংশগুলো উদ্ধারের চেষ্টা করছিল। এক মাস পর, গত ৮ জুলাই, যুদ্ধশিবিরের ক্যান্টিনে সিগারেট ও চকোলেট দিয়ে ফেরার সময় মর্টারের গুলিতে মারাত্মকভাবে আহত হন হেমিংওয়ে। আহত অবস্থাতেই নিজের দিকে ভ্রƒক্ষেপ না করে তিনি ইতালীয় সৈনিকদের বহন করে নিরাপদ স্থানে নিয়ে চলেন। দুর্ঘটনায় তার দুই পায়ে মর্টারের টুকরাগুলো ঢুকে গিয়েছিল। জরুরি একটি অপারেশনের পর তাকে একটি ফিল্ড হাসপাতালে পাঁচ দিন কাটাতে হয়। তারপর তাকে স্থানান্তর করা হয় মিলানের রেড ক্রসের হাসপাতালে। এ হাসপাতালে তাকে কাটাতে হয় ছয় মাস। যুদ্ধের অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি লেখেন ‘আ ফেয়ারওয়েল টু আর্মস।’
১৯৮৬ সালে প্রকাশিত ‘দ্য গার্ডেন অব ইডেন’ হেমিংওয়ের মরণোত্তর প্রকাশিত দ্বিতীয় উপন্যাস। উপন্যাসটি আসলে হেমিংওয়ের ব্যক্তিজীবন-সংশ্লিষ্ট। ইতালিতে মর্টারে আঘাতে আহত হওয়ার পর তো তিনি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন ছয় মাস। হাসপাতালেই তিনি ভালোবেসে ফেলেন এগনেস ভন কুরোস্কি নামের রেডক্রসের এক নার্সকে। এগনেস আর হেমিংওয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন কয়েক মাসের মধ্যে আমেরিকাতেই হবে তাদের বিয়ে। ১৯১৯ সালের জানুয়ারিতে হেমিংওয়ে ফিরে এলেন আমেরিকায়। অপেক্ষা করতে লাগলেন এগনেসের জন্য। কিন্তু হঠাৎ ইতালি থেকে এগনেসের প্রত্যাখ্যানের চিঠি এলো। এক ইটালিয়ান কর্মকর্তার সঙ্গে এগনেসের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে শুনে হেমিংওয়ে ভেঙে পড়লেন। মাত্র কুড়ি বছর বয়সে জীবনের প্রথম প্রেমে ব্যর্থ হলেন তিনি। ‘টরেন্টো স্টার’ পত্রিকায় চাকরি করার সময় প্রেম হয় এলিজাবেথ হ্যাডলি রিচার্ডসনের সঙ্গে। হেমিংওয়ে ভালোবাসলেন তাকে, বিয়ে করে শুরু করলেন সংসার। প্যারিসে আসার পর হেমিংওয়ে প্রেমে পড়েন পলিন পাইফার নামের এক আমেরিকান সাংবাদিকের। ফাটল ধরে হেমিংওয়ের সংসারে। ১৯২৭ সালের মে মাসে হ্যাডলি রিচার্ডসনকে ডিভোর্স দিয়ে বিয়ে করেন পলিন পাইফারকে।
‘দ্য গার্ডেন অব ইডেন’ রচনা শুরু করেছিলেন ১৯৪৬ সালে। পরবর্তী পনেরো বছরে তিনি এর পা-ুলিপি নিয়ে কাজ করেন। এ সময় তিনি ‘দ্য ওল্ডম্যান অ্যান্ড দ্য সি’, ‘দ্য ডেঞ্জারাস সামার’, ‘আ মুভেবল ফিস্ট ও আইল্যান্ডস ইন দ্য স্ট্রিম’ রচনা করেন। উপন্যাসটির কাহিনীর সূত্রপাত হয় যখন হেমিংওয়ে তার দ্বিতীয় স্ত্রী পলিন ফাইফারকে নিয়ে মধুচন্দ্রিমায় যান এবং হ্যাডলি রিচার্ডসনকে তালাক দেওয়ার কিছুদিন পর থেকে। পুরুষ মুখ্য চরিত্র হলো যৌবনকালের হেমিংওয়ে নিজেই। আকর্ষণীয় ও ধনী নারী চরিত্রটি হলো পলিন। ‘দ্য গার্ডেন অব ইডেন’ হেমিংওয়ের নবম উপন্যাস। ১৯৮৬ সালের মে মাসে, তার মৃত্যুর ২৫ বছর পর, চার্লস স্ক্রিবনার্স সন্স উপন্যাসটি প্রকাশ করে। বইটির প্রথম মুদ্রণের এক লাখ কপি বিক্রি হয়েছিল। ‘দ্য গার্ডেন অব ইডেন’ উপন্যাসে তিনি নারী-পুরুষ সম্পর্কের বিশ্লেষণসহ লিঙ্গ ভূমিকার বৈপরীত্য দেখিয়েছেন।
‘দ্য টরেন্টস অব স্প্রিং’ একটি উপন্যাসিকা। প্রকাশিত হয় ১৯২৬ সালে। এটি তার প্রথম দীর্ঘ কাজ এবং তিনি এটি শেরউড অ্যান্ডারসনের ডার্ক লাফটারের ব্যঙ্গ হিসেবে রচনা করেছেন। ধারণা করা হয়, হেমিংওয়ে ‘দ্য টরেন্টস অব স্প্রিং’ রচনা করেছিলেন তার প্রকাশক বনি অ্যান্ড লিভরাইটের সঙ্গে চুক্তি থেকে বের হয়ে আসার জন্য; যদিও হেমিংওয়ে তা অস্বীকার করেছিলেন। বইটি প্রত্যাখ্যান করার মধ্য দিয়ে বনি অ্যান্ড লিভরাইট তাদের চুক্তি বাতিল করেন। ১০ দিনে রচিত ‘দ্য টরেন্টস অব স্প্রিং’ ছিল দাম্ভিক লেখকদের নিয়ে ব্যঙ্গ রচনা। হেমিংওয়ে ১৯২৫ সালের ডিসেম্বর মাসের শুরুতে বইটির পা-ুলিপি জমা দেন এবং মাসের শেষ ভাগে কাজটি প্রত্যাখ্যাত হয়। ১৯২৬ সালের জানুয়ারি মাসে ম্যাক্স পারকিন্স স্ক্রিবনার্স থেকে ‘দ্য টরেন্টস অব স্প্রিং’ এবং তার অনাগত কাজগুলোও প্রকাশ করতে সম্মতি জানান। ‘দ্য টরেন্টস অব স্প্রিং’ বইটি ১৯২৫ সালের মে মাসে স্ক্রিবনার্স থেকে প্রকাশিত হয়। প্রথম সংস্করণের ১২৫০ কপি মুদ্রিত হয়েছিল।
‘টু হ্যাভ অর হ্যাভ নট’ উপন্যাসটি ১৯৩৭ সালে চার্লস স্ক্রিবনার্স সন্স থেকে প্রকাশিত হয়। উপন্যাসটির কেন্দ্রীয় চরিত্রে রয়েছেন হ্যারি মরগান, যিনি একটি মাছ ধরার নৌকার ক্যাপ্টেন। তিনি সুহৃদ; কিন্তু তার আর্থিক অবস্থা তাকে কিউবা ও ফ্লোরিডায় চলমান কালোবাজারিতে যুক্ত হতে বাধ্য করে। ‘দ্য টরেন্টস অব স্প্রিং’-এর মতো এটিও যুক্তরাষ্ট্রের পটভূমিতে রচিত। এটি ১৯৩৫ থেকে ১৯৩৭ সালের মধ্যে বিক্ষিপ্তভাবে রচিত এবং হেমিংওয়ে বইটি স্পেনীয় গৃহযুদ্ধ চলাকালীন স্পেনে যাতায়াতের পথে সংশোধন করেন। এতে ১৯৩০-এর দশকের ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও কিউবার চিত্রায়ণ ঘটেছে এবং সেই সময়ের ও স্থানের সামাজিক ঘটনাবলি তুলে ধরা হয়েছে। এটি শুরুতে ছোটগল্প হিসেবে লেখা হয়েছিল এবং ১৯৩৪ সালে কসমোপলিটন-এ ‘ওয়ান ট্রিপ অ্যাক্রস’ নামে প্রকাশিত হয়েছিল, যেখানে হ্যারি মরগান চরিত্রটিকে পাঠকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। দ্বিতীয় গল্পটি ১৯৩৬ সালে রচিত এবং স্কয়ার-এ ‘দ্য ট্রেডসম্যানস রিটার্ন’ নামে প্রকাশিত হয়। এ সময় হেমিংওয়ে হ্যারি মরগানকে নিয়ে একটি উপন্যাস লেখার সিদ্ধান্ত নেন। দুর্ভাগ্যবশত উপন্যাসের লেখনী স্পেনীয় গৃহযুদ্ধের শুরুর সঙ্গে কাকতালীয়ভাবে মিলে যায়। ‘টু হ্যাভ অর হ্যাভ নট’ ১৯৩৭ সালের ১৫ অক্টোবর চার্লস স্ক্রিবনার্স সন্স থেকে প্রকাশিত হয়। প্রথম সংস্করণের প্রায় ১০ হাজার কপি বিক্রি হয়।
‘দ্য সান অলসো রাইজেস’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ১৯২৬ সালে। এতে প্যারিস থেকে পাম্পলোনার সান ফার্মিন উৎসবে ষাঁড়ের দৌড় ও ষাঁড়ের যুদ্ধ দেখতে যাওয়া একদল মার্কিন ও ব্রিটিশ প্রবাসীর গল্প বিবৃত হয়েছে। প্রকাশিত হওয়ার পর বইটি মিশ্র সমালোচনা অর্জন করে। হেমিংওয়ের জীবনীকার জেফ্রি মেয়ার্স লেখেন যে এ বইটিকে বর্তমান সময়ে হেমিংওয়ের শ্রেষ্ঠ কর্ম বলে গণ্য করা হয় এবং হেমিংওয়ে বিষয়ক প-িত লিন্ডা ওয়েগনার-মার্টিন এটিকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস বলে অভিহিত করেন। ১৯২৫ সালের অক্টোবর মাসে স্ক্রিবনার্স উপন্যাসটি যুক্তরাষ্ট্রে প্রকাশ করে। এক বছর পর ‘জনাথন কেপ ফিয়েস্টা’ শিরোনামে লন্ডনে উপন্যাসটি প্রকাশ করে।
‘ফর হুম দ্য বেল টোলস’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ১৯৪০ সালে। স্পেনের গৃহযুদ্ধের সময় রবার্ট জর্ডান নামে একজন তরুণ মার্কিনের গল্প বর্ণিত হয়েছে এতে। ডিনামিটার হিসেবে তাকে সেগোভিয়া শহরে আক্রমণকালে একটি ব্রিজ উড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। ‘দ্য সান অলসো রাইজেস’, ‘আ ফেয়ারওয়েল টু আর্মস’ ও ‘দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি’-এর সঙ্গে যৌথভাবে এ উপন্যাসকে হেমিংওয়ের অন্যতম সেরা কাজ বলে গণ্য করা হয়। ১৯৪০ সালের ২১ অক্টোবর প্রকাশিত উপন্যাসটির প্রথম সংস্করণে ৭৫ হাজার কপি বিক্রি হয়েছিল।
হেমিংওয়ের জীবৎকালে প্রকাশিত সর্বশেষ উপন্যাস ‘দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি’। ১৯৫১ সালে তিনি কিউবায় অবস্থানকালীন রচনা করেন এটি। প্রকাশিত হয় ১৯৫২ সালে। বলা যায়, এটি তার সেরা উপন্যাসগুলোর একটি। উপন্যাসের প্রধান কাহিনী বর্ণিত হয়েছে উপসাগরীয় স্রোতে বিশাল এক মারলিন মাছের সঙ্গে এক বৃদ্ধ জেলের সংগ্রামের কাহিনী। ১৯৫৩ সালে ‘দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি’ সাহিত্যে পুলিৎজার পুরস্কার এবং ১৯৫৪ সালে নোবেল পুরস্কার লাভ করে। উপন্যাসটি লিখেছিলেন তিনি জীবনের শেষের দিকে। প্রথমে নাকি উপন্যাসটি ছাপা হয়েছিল প্রায় ৫০ হাজার কপি। পৃথিবীর বেশির ভাগ ভাষায় অনূদিত হয়। অনেকে বলেন, বুড়ো সান্তিয়াগো এই উপন্যাসের নায়ক। আবার কারো কারো মতে, সমুদ্রই এই উপন্যাসের নায়ক। সমুদ্র সব প্রাণীর শিক্ষক। বুড়ো সান্তিয়াগো তার ছাত্র। সে সমুদ্রকে বলে দয়ালু। যেমন স্পেনের লোকেরা ভালোবেসে বলে। যারা সমুদ্রকে ভালোবাসে, তারাই আবার গালমন্দ করে। ছোকরা জেলে, যারা মোটরবোট আর বয়া নিয়ে হাঙর ধরে, বাজারে হাঙর মাছের তেল বেচে দুপয়সা কামায়, তাদের ধারণা, সমুদ্রটা পুরুষ। তারা সমুদ্রকে প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, শত্রু ভাবে। কিন্তু বুড়ো মানুষরা সমুদ্রকে তুলনা করে নারীর সঙ্গে। সমুদ্র থেকে পায় সোহাগ আর সাহায্য। সমুদ্র নিয়ে উপন্যাসের বুড়ো সান্তিয়াগোর এক রকম মানসিকতা তৈরি হয়। বুড়ো মানুষটি, যে কি না নিজে জেলে হয়ে ওঠার আগে একটা কচ্ছপ ধরার বোটে কাজ করত। তার নিজের কাছে মনে হতো তার হৃপি- আর পাগুলো যেন কচ্ছপের। সে কচ্ছপের সাদা সাদা ডিম খেত শক্তি বাড়ানোর জন্য। রোজ এক গ্লাস হাঙরের তেল খেত বুকে ঠা-া ও সর্দি বসার হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য। এভাবেই সমুদ্রের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেছিল বুড়ো সান্তিয়াগো।
উপন্যাসটির বেশির ভাগ জুড়ে সমুদ্র। উপন্যাসে সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়া বুড়ো সান্তিয়াগোর সংগ্রামের কাহিনীর সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্রের সূক্ষ¥ বর্ণনা পাঠককে আকৃষ্ট করে দারুণভাবে। সমুদ্রের পানি কেটে বেরিয়ে যাওয়া উড়ুক্কু মাছ, তলা থেকে বেরিয়ে আসা নানা জাতের হাঙর, হাঙরের বিভিন্ন শারীরিক কসরত এসব বর্ণনা রয়েছে দারুণভাবে। সান্তিয়াগো সমুদ্রের এক বিরাট মাছকে হত্যা করে। দিনের পর দিন তাকে বড়শি বিঁধিয়ে রাখে। এক ভয়াবহ যন্ত্রণা পায় মাছটি। প্রথমে মাছটি যখন সহজে ধরা দেয়নি, তখন বুড়ো হুংকার ছেড়ে বলে, ‘যত বড়ই হোক, ওটাকে আমি মারবই। ওর বিরাটত্ব আর বড়াই আমি শেষ করবই। ওকে আমি দেখাব, মানুষ কী করতে পারে আর মানুষের লেগে থাকার শক্তি কত ভয়ঙ্কর।’
উপন্যাসটিতে হেমিংওয়ে দেখিয়েছেন যে মানুষ সম্প্রদায় মনে করে তারা ছাড়া দুনিয়ার বাকি সব জীবজন্তু, উদ্ভিদসবই মানুষের ভোগ্য এবং মানুষই হচ্ছে প্রাণিজগতের রাজা, এই বুড়ো তাদেরই প্রতিনিধি। মাছটি নৌকায় বেঁধে আনার সময় সমুদ্রের হাঙরগুলো উঠে আসতে থাকে। আর একটি হাঙর মৃত মাছটির গায়ে কামড় দিয়ে অনেকখানি খুবলে নেয়। এরপর বুড়ো আর মাছটির দিকে তাকায় না। ভাবতেই পারে না, মাছটির অঙ্গহানি হয়েছে। তবে মাছটিকে কেউ খাচ্ছে, তার জন্য যে খারাপ লাগছে তা নয়, তার খারাপ লাগছে এ জন্য যে এতে সে দাম কম পাবে। হাঙরের দল মাছটিকে আস্ত নিয়ে যেতে দেয়নি। সমুদ্রের হাতে শেষ পর্যন্ত মানুষের প্রতিনিধি বুড়ো সান্তিয়াগোর পরাজয় হয়।
হেমিংওয়ে জন্মেছিলেন ১৮৯৯ সালের ২১ জুলাই আর আত্মহত্যায় মৃত্যুবরণ করেন ১৯৬১ সালের ২ জুলাই। এই মহান ঔপন্যাসিকের প্রতি শ্রদ্ধা।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877